Header Ads Widget

Responsive Advertisement

বাংলাদেশে কেন গরুর মাংসের বাজার খুঁজছে ব্রাজিল?

বাংলাদেশকে ৪৯৫ টাকা কেজিতে গরুর মাংস দেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছে ব্রাজিলছবি : রয়টার্স

ব্রাজিল এই বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর একটি। দক্ষিণ আমেরিকার সবচেয়ে বড় দেশ। বিপুল তার আয়তন, অসীম তার বৈভব। ২২ কোটির কাছাকাছি জনসংখ্যা। পৃথিবীর ফুসফুস বলে পরিচিত আমাজন বনাঞ্চলের ৬০ ভাগ এই ব্রাজিলেই অবস্থিত।
বাংলাদেশের সঙ্গে ব্রাজিলের বিশাল দূরত্ব। এ দেশের প্রায় সোয়া কোটি মানুষ পৃথিবীর নানান দেশে কাজে–কর্মে নিয়োজিত। কিন্তু ব্রাজিল যেন বাংলাদেশিদের কাছে ‘দুর্গম গিরি, কান্তার–মরু, দুস্তর পারাবার।

এত দূরত্বের পরও ব্রাজিল দেশটি মনে হয় আমাদের কত চেনা, কত আপন। এর কারণ ফুটবল নামের গোলাকার ওই বস্তু। শয়ে শয়ে তারকা ফুটবলার জন্ম দিয়েছে দেশটি। আর বাংলাদেশের ফুটবল–ভক্তদের একটি অংশ ব্রাজিল দলকে সমর্থন করে, ব্রাজিলের পতাকাকে ভালোবাসে।

অতি সম্প্রতি বাংলাদেশ সফর করলেন ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বর্ষীয়ান কূটনীতিক মাউরো ভিয়েরা। এটা ছিল ব্রাজিলের কোনো পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রথম বাংলাদেশ সফর। তবে তাঁর সফরের উদ্দেশ্য ততটা ফুটবল ছিল না। দুটি দেশ কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করে কীভাবে পরস্পরের সুবিধা কাজে লাগাতে পারে, তা নিয়েই মূলত আলাপ। এই সফরে বিশেষভাবে নজর কেড়েছে ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বাংলাদেশকে ৪৯৫ টাকা কেজিতে গরুর মাংস দেওয়ার প্রস্তাব।

এ ছাড়া ব্রাজিলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও পাটের শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধা, সে দেশ থেকে তুলা আমদানি, ব্রিকসে বাংলাদেশের যোগ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্রাজিলের সমর্থন প্রত্যাশা—অনেক কিছুই আলোচনা হয়েছে। ব্রাজিলের ওষুধের বাজার প্রায় ৩০ বিলিয়ন ডলারের এবং এর মধ্যে ১০ বিলিয়ন ডলারের মতো তারা আমদানি করে। বাংলাদেশের ওষুধ কোম্পানিগুলো এই সুবিধা কাজে লাগাতে পারে।

ব্রাজিল অনেক বড় অর্থনীতির দেশ। এর বিশাল বাজারে ঢোকার সুযোগ পেলে বাংলাদেশ লাভবানই হবে। এত দিন এটি উপেক্ষিতই ছিল।

এখন দুই দেশের মধ্যে আলোচনা আরও এগিয়ে নিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ব্রাজিল সফর করবেন। আগামী জুলাই মাসে এ সফর হতে পারে।

বলতেই হয়, ব্রাজিলের এখনকার প্রেসিডেন্ট লুইস ইনাসিও লুলা দা সিলভা একজন মানবিক, প্রাজ্ঞ ও অগ্রসর মানুষ। আগের প্রেসিডেন্ট জইর বলসোনারোর মতো ডানপন্থী, প্রতিক্রিয়াশীল নন। আশা করা যেতে পারে, লুলার আমলে বাংলাদেশ-ব্রাজিল কূটনৈতিক সম্পর্ক নানা ক্ষেত্র থেকে উন্নত হওয়ার সুযোগ রয়েছে।

বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পারছে ব্রাজিলের মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলোও। দেশটির অন্যতম মাংস প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান জেবিএস বলেছে, অবৈধ বন উজাড়ে তাদের প্রতিষ্ঠানটি শূন্য সহনশীলতা নীতি অবলম্বন করবে। এই নীতি মেনে না চলায় প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে ১৪ হাজার সরবরাহকারীকে নিষিদ্ধ করেছে।

তবে এ লেখায় কেবল ব্রাজিলের গরুর মাংস রপ্তানির প্রস্তাবের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করব।

তার আগে ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রস্তাব ও বাংলাদেশের পক্ষে বক্তব্যটা একটু চোখ বুলিয়ে নিই। ব্রাজিল আগে থেকেই বাংলাদেশে স্বল্পমূল্যে মাংসজাত পণ্য,বিশেষ করে গরুর মাংস রপ্তানির জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে আসছিল। বাংলাদেশ মাংস আমদানির ওপর যে বিধিনিষেধ দিয়ে রেখেছে, সেটা বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বিধির সঙ্গে সাংঘর্ষিক বলে মনে করে ব্রাজিল,যদিও বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে সেটি তারা ডব্লিউটিও ফোরামে তোলেনি (বিবিসি বাংলা)।

তবে ঢাকায় ব্রাজিলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভিয়েরার সঙ্গে সাক্ষাতের পর বাংলাদেশের বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী আহসানুল ইসলাম বলেছেন, মাংসজাত পণ্য নয়, বরং কোরবানি সামনে রেখে ব্রাজিল থেকে গরু আমদানি করতে চায় বাংলাদেশ। তিনি বলেছেন,আমাদের এখানে প্রাণীজ আমিষ রেস্ট্রিকটেড। পোলট্রি ও অন্য মাংস আমরা আমদানি করি না। এখন বিষয়টি চূড়ান্ত অনুমোদন হলে দাম, হেলথ সার্টিফিকেশন, লাইসেন্সিংসহ অন্য বিষয়ে আলোচনা হবে।

ভারত থেকে গরু আমদানি নিষিদ্ধ হওয়ার পর বাংলাদেশে পশুপালন খাত, বিশেষ করে গরুর খামার অনেক বেড়েছে। অনেক বড় ব্যবসায়ী এ খাতে বিনিয়োগ করেছেন। বাংলাদেশ মাংস উৎপাদনে এখন প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। কিন্তু বাজারে গরুর মাংসের উচ্চমূল্য। সাশ্রয়ী দামে এই প্রাণীজ আমিষ খেতে পারছেন না সাধারণ মানুষ। এখন লেখা যখন লিখছি (মঙ্গলবার), সেদিনও বাজারে গরুর মাংসের কেজি কমবেশি ৮০০ টাকা। অর্থাৎ মাংস উৎপাদনে বাংলাদেশের স্বয়ংসম্পূর্ণ হওয়ার কোনো সুফল সাধারণ ভোক্তারা পাচ্ছেন না।

সুফল পাচ্ছে কেবল বড় খামারিরা, যাঁদের হাতে বাজারটা জিম্মি। এ কারণে শাহজাহানপুরের খলিলের মতো মাংস ব্যবসায়ীদের অনেকেই দীর্ঘদিন ধরে ‘বর্ডার খুলে’ দেওয়ার কথা বলছেন। ভারতীয় গরু আমদানি হয়ে এলে তাঁরা ভোক্তাকে আরেকটু কম দামে খাওয়াতে পারতেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, আমাদের খামারিরা গরু আমদানির পক্ষে নন, বরং বিপক্ষে।

এখন এই ৭৫০ থেকে ৮০০ টাকা কেজির বাজারে ৪৯৫ টাকায় ব্রাজিলের গরুর মাংস দেওয়ার প্রস্তাব কৌতূহলোদ্দীপকও বটে। যদিও এর সঙ্গে শুল্ক যুক্ত হবে কি না, তা এখনো পরিষ্কার নয়।

এবার পাঠকদের জন্য কিছু তথ্য-পরিসংখ্যান হাজির করতে হয়।

গরুর মাংস উৎপাদনে বিশ্বে শীর্ষস্থানে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এর পরেই ব্রাজিল। তারপরে রয়েছে চীন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারত। আর ভোগের দিক থেকে ধরলেও শীর্ষে ওই যুক্তরাষ্ট্র। এরপর চীন। তারপরের তিনটি দেশ ব্রাজিল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ভারত।
এরপর রপ্তানি ও আমদানির তথ্যে চোখ বোলানো যাক। রপ্তানির দিক থেকে শীর্ষে আছে ব্রাজিল। দ্বিতীয় স্থানে চলে এসেছে অস্ট্রেলিয়া। এরপরের তিনটি দেশ ভারত, যুক্তরাষ্ট্র ও আর্জেন্টিনা। আর সবচেয়ে বেশি গরুর মাংস আমদানি করে চীন। এরপর রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন। এ তথ্য যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি বিভাগ বা ইউএসডিএর।

লক্ষণীয় হলো, যুক্তরাষ্ট্র গরুর মাংসের বড় ক্রেতা হলেও ব্রাজিল থেকে তারা মাংস নেয় না। তারা মাংস কেনে অস্ট্রেলিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়া থেকে। ব্রাজিল থেকে বেশি মাংস কেনে চীন।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ব্রাজিলে গরুর মাংস উৎপাদন ব্যাপকভাবে বেড়েছে। দেশটির বিশাল তৃণভূমির সুবিধা পাচ্ছে খামারগুলো। তেপান্তরের মাঠে ঘাসের অভাব নেই।

তবে অভিযোগ রয়েছে, ডিফরেস্টেশন বা বন উজাড় করে সেখানে খামার স্থাপন করা হচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং স্বয়ং ব্রাজিলের পরিবেশবাদীরা এ নিয়ে একাট্টা হয়েছেন। বন উজাড় করে স্থাপন করা খামারের মাংস যেন বিদেশি ক্রেতারা না কেনেন, তা নিয়ে চলছে জোর প্রচারণা। ইউরোপের বিভিন্ন সুপারমার্কেট কর্তৃপক্ষও পরিবেশবাদীদের দাবির সঙ্গে একাত্ম না হয়ে পারছে না।

ব্রাজিলের একটি পরিবেশবাদী সংগঠন অভিযোগ করেছে, গবাদিপশুকে অবৈধ স্থানে স্থাপিত খামারে লালন–পালন করা হয় এবং তারপর সেগুলোকে কসাইখানায় পাঠানোর আগে বৈধ খামারে বিক্রি করা হয়৷ এর ফলে পশুটি আসলে কোন জায়গা থেকে আসছে, সে তথ্য ধামাচাপা দেওয়ার সুযোগ তৈরি হয়।

এমন অবস্থায় গরুর মাংস আমদানিকারকদের অনেকেই ব্রাজিলের বাইরে থেকে মাংস আনার কথা ভাবছেন।

ব্রাজিলের সাবেক প্রেসিডেন্ট বলসোনারোর আমলে আমাজন বন ধ্বংস করে খামার করার প্রবণতা বেড়ে যায়। দেশটিতে দারিদ্র্য কমবে—এই অজুহাতে তাঁর সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে বন ধ্বংস করে একের পর এক বাণিজ্যিক খামার তৈরি করা হয়।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের ডিফরেস্টশেন প্রবিধানে বলা হয়েছে, ইউরোপের কোনো প্রতিষ্ঠান ব্রাজিল থেকে কোনো ধরনের গরুর মাংস বা চামড়া আমদানি করতে পারবে না, যা বন কেটে তৈরি হওয়া খামারে উৎপাদিত। ২০২৪–এর ৩০ ডিসেম্বর থেকে এ বিধি কড়াকড়িভাবে জারি হওয়ার কথা।

বিষয়টির গুরুত্ব বুঝতে পারছে ব্রাজিলের মাংস প্রক্রিয়াজাতকরণ প্রতিষ্ঠানগুলোও। দেশটির অন্যতম মাংস প্রক্রিয়াজাত প্রতিষ্ঠান জেবিএস বলেছে, অবৈধ বন উজাড়ে তাদের প্রতিষ্ঠানটি শূন্য সহনশীলতা নীতি অবলম্বন করবে। এই নীতি মেনে না চলায় প্রতিষ্ঠানটি এরই মধ্যে ১৪ হাজার সরবরাহকারীকে নিষিদ্ধ করেছে।

এখন মার্কেটে টিকে থাকতে গেলে ব্রাজিলকে নতুন নতুন বাজার খুঁজতে হবে। বাংলাদেশকে সস্তায় মাংস দিতে চাওয়া ব্রাজিলের নতুন বাজার খোঁজার কৌশলেরই অংশ বলে ঠাওর হচ্ছে। পরিবেশের বিষয়টি আমাদের নীতিনির্ধারকেরা নিশ্চয় বেমালুম পাশ কাটিয়ে যাবেন না।

তবে বাণিজ্য প্রতিমন্ত্রী যথার্থ বলেছেন, মাংস নয়, ব্রাজিল থেকে গরু আমদানির আলোচনা একরকম এগোতে পারে। পাশাপাশি আমরা ব্রাজিল থেকে গরুর সিমেন আমদানি করতে পারি। ভারত অনেক দিন ধরেই ব্রাজিলিয়ান গরুর সিমেন আমদানি করছে। এটা আমাদের দেশে গরুর উন্নত জাত তৈরিতে ভূমিকা রাখবে। গরু গায়ে-গতরে বড় হলে আমরা মাংস-দুধ বেশি পাব।

-সূত্র -প্রথম আলো

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ